Monday, August 9, 2010

পুরাতন ভৃত্য

ভূতের মতন চেহারা যেমন , নির্বোধ অতি ঘোর ।
যা - কিছু হারায় , গিন্নি বলেন , ‘ কেষ্টা বেটাই চোর । '
উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত , শুনেও শোনে না কানে ।
যত পায় বেত না পায় বেতন , তবু না চেতন মানে ।
বড়ো প্রয়োজন , ডাকি প্রাণপণ , চীৎকার করি ‘ কেষ্টা ' —
যত করি তাড়া , নাহি পাই সাড়া , খুঁজে ফিরি সারা দেশটা
তিনখানা দিলে একখানা রাখে , বাকি কোথা নাহি জানে —
একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা ক ' রে আনে ।
যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে নিদ্রাটি আছে সাধা —
মহাকলরবে গালি দেই যবে ‘ পাজি হতভাগা গাধা ' —
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে , দেখে জ্বলে যায় পিত্ত !
তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার — বড়ো পুরাতন ভৃত্য ।

ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি বলে , ‘ আর পারি নাকো !
রহিল তোমার এ ঘর দুয়ার , কেষ্টারে লয়ে থাকো ।
না মানে শাসন ; বসন বাসন অশন আসন যত
কোথায় কী গেল ! শুধু টাকাগুলো যেতেছে জলের মতো ।
গেলে সে বাজার সারা দিনে আর দেখা পাওয়া তার ভার —
করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর !
শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে , আনি তার টিকি ধরে ;
বলি তারে , ‘ পাজি , বেরো তুই আজই , দূর করে দিনু তোরে ! '
ধীরে চলে যায় , ভাবি গেল দায় ; পরদিনে উঠে দেখি
হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি ।
প্রসন্নমুখ , নাহি কোনো দুখ , অতি - অকাতর চিত্ত !
ছাড়ালে না ছাড়ে , কী করিব তারে মোর পুরাতন ভৃত্য ।

সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি ।
করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি ।
পরিবার তায় সাথে যেতে চায় , বুঝায়ে বলিনু তারে
পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য , নহিলে খরচ বাড়ে ।
লয়ে রশারশি করি কষাকষি পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি
বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে গৃহিণী কহিল কাঁদি ,
‘ পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে কষ্ট অনেক পাবে । '
আমি কহিলাম ‘ আরে রাম রাম ! নিবারণ সাথে যাবে । '

রেলগাড়ি ধায় ; হেরিলাম হায় নামিয়া বর্ধমানে
কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত তামাক সাজিয়া আনে ।
স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর কত বা সহিব নিত্য !
যত তারে দুষি তবু হনু খুশি হেরি পুরাতন ভৃত্য ।
নামিনু শ্রীধামে , দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত
লাগিল পান্ডা , নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত ।
জন ছয় সাতে মিলি একসাথে পরমবন্ধুভাবে
করিলাম বাসা , মনে হল আশা আরামে দিবস যাবে ।
কোথা ব্রজবালা ! কোথা বনমালা ! কোথা বনমালী হরি !
কোথা হা হন্ত , চিরবসন্ত ! আমি বসন্তে মরি ।
বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ —
আমি একা ঘরে ব্যাধি - খরশরে ভরিল সকল অঙ্গ ।
ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ , ‘ কেষ্ট , আয় রে কাছে ।
এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেষে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে । '
হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক , সে যেন পরম বিত্ত ।
নিশিদিন ধরে দাঁড়ায়ে শিয়রে মোর পুরতন ভৃত্য ।

মুখে দেয় জল , শুধায় কুশল , শিরে দেয় মোর হাত ;
দাঁড়ায়ে নিঝুম , চোখে নাই ঘুম , মুখে নাই তার ভাত ।
বলে বার বার , ‘ কর্তা , তোমার কোনো ভয় নাই , শুন ,
যাবে দেশে ফিরে মাঠাকুরানীরে দেখিতে পাইবে পুন । '
লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম ; তাহারে ধরিল জ্বরে —
নিল সে আমার কালব্যাধিভার আপনার দেহ - ' পরে ।
হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু দিন , বন্ধ হইল নাড়ী —
এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে , এতদিনে গেল ছাড়ি ।
বহুদিন পরে আপনার ঘরে ফিরিনু সারিয়া তীর্থ —
আজ সাথে নেই চিরসাথী সেই মোর পুরাতন ভৃত্য ।