Wednesday, October 24, 2012

ভালোবেসে সখী

ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো-- তোমার
মনের মন্দিরে।

আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো-- তোমার
চরণমঞ্জীরে॥

ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি-- তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥

মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী-- তোমার
কনককঙ্কণে॥

আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো-- তোমার
অলকবন্ধনে।

আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো-- তোমার
ললাটচন্দনে।

আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো-- তোমার
অঙ্গসৌরভে।

আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো-- তোমার
অতুল গৌরবে॥

ভালো যদি বাস সখী

ভালো যদি বাস, সখী, কী দিব গো আর?
কবির হৃদয় এই দিব উপহার।

এত ভালোবাসা, সখী, কোন্‌ হৃদে বলো দেখি?
কোন্‌ হৃদে ফুটে এত ভাবের কুসুমভার।

তা হলে এ হৃদিধামে তোমারি তোমারি নামে,
বাজিবে মধুর স্বরে মরমবীণার তার।

যা-কিছু গাহিব গান ধ্বনিবে তোমারি নাম,
কী আছে কবির বলো, কী তোমারে দিব আর।।

বড়ো আশা ক'রে এসেছি

বড়ো আশা ক'রে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও,
ফিরায়ো না জননী।।

দীনহীনে কেহ চাহে না, তুমি তারে রাখিবে জানি গো।
আর আমি-যে কিছু চাহি নে, চরণতলে বসে থাকিব।
আর আমি-যে কিছু চাহি নে, জননী ব’লে শুধু ডাকিব।

তুমি না রাখিলে, গৃহ আর পাইব কোথা, কেঁদে কেঁদে কোথা বেড়াব–
ওই-যে হেরি তমসঘনঘোরা গহন রজনী।।

বঁধু, মিছে রাগ কোরো না

বঁধু, মিছে রাগ কোরো না, কোরো না।
মম মন বুঝে দেখো মনে মনে--মনে রেখো, কোরো করুণা॥

পাছে আপনারে রাখিতে না পারি
তাই কাছে কাছে থাকি আপনারি--
মুখে হেসে যাই, মনে কেঁদে চাই--সে আমার নহে ছলনা॥

দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ,
ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ--
পলকের পরে থাকে বুক ভ'রে চিরজনমের বেদনা।

তারি মাঝে কেন এত সাধাসাধি,
অবুধ আঁধারে কেন মরি কাঁদি--
দূর হতে এসে ফিরে যাই শেষে বহিয়া বিফল বাসনা॥

আমি চিনি গো চিনি

আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী॥

তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।

আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী।

ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে,
আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী॥

প্রতিদান

আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী;
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হয়েছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাধি তার ঘর ।
আমার একুল ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
যে মোরে দিয়েছে বিষ ভরা বান,
আমি দেই তারে বুক ভরা গান;
কাটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,
আপন করিতে কাদিঁয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর ।
মোর বুকে যেবা কবর বেধেছে আমি তার বুক ভরি,
রঙ্গীন ফুলের সোহাগ জড়ান ফুল মালঞ্চ ধরি।
যে মুখে সে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে সখী, তারি মুখ খানি,
কত ঠাই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর,
আপন করিতে কাদিয়া বেড়াই যে মোরে করিয়াছে পর ।

Wednesday, October 17, 2012

বঁধু কোন্‌ আলো

বঁধু, কোন্‌ আলো লাগল চোখে!
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে!

ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে,
জন্ম-জনম গেল বিরহশোকে।

অস্ফুটমঞ্জরী কুঞ্জবনে,
সংগীতশূন্য বিষণ্ন মনে
সঙ্গীরিক্ত চিরদুঃখরাতি
পোহাব কি নির্জনে শয়ন পাতি!

সুন্দর হে, সুন্দর হে,
বরমাল্যখানি তব আনো বহে,
অবগুণ্ঠনছায়া ঘুচায়ে দিয়ে
হেরো লজ্জিত স্মিতমুখ শুভ আলোকে॥

আমি তোমার প্রেমে

আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।
আমি সকল দাগে হব দাগি॥

তোমার পথের কাঁটা করব চয়ন, যেথা তোমার ধুলার শয়ন
সেথা আঁচল পাতব আমার-- তোমার রাগে অনুরাগী॥

আমি শুচি-আসন টেনে টেনে বেড়াব না বিধান মেনে,
যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে তাহারি ছাপ বক্ষে মাগি॥

আমি জেনে শুনে

আমি, জেনে শুনে বিষ করেছি পান।
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।

যতই দেখি তারে ততই দহি,
আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,
তবু পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি,
লই গো বুক পেতে অনল-বাণ।

যতই হাসি দিয়ে দহন করে,
ততই বাড়ে তৃষা প্রেমের তরে,
প্রেম-অমৃত-ধারা ততই যাচি,
যতই করে প্রাণে অশনি দান।

আমারে তুমি অশেষ করেছ

আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব–
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।।

কত-যে গিরি কত-যে নদী -তীরে
বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
কাহারে তাহা কব।।

তোমারি ওই অমৃতপরশে আমার হিয়াখানি
হারালো সীমা বিপুল হরষে, উথলি উঠে বাণী।
আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী–
হল না সারা, কত-না যুগ ধরি
কেবলই আমি লব।।

Monday, October 15, 2012

আমার সোনার হরিণ চাই

তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।
মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই॥

সে-যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা।
সে-যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা।
আমি ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই--
আামি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥

তোরা পাবার জিনিস হাতে কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে--
যারে যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে।
আমার যা ছিল তা গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে--
আমার ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস, বুঝি মরি তারি শোকে?
আমি আছি সুখে হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই।
আমি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥

আমার প্রাণের মানুষ

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে॥

আছে সে নয়নতারায় আলোকধারায়, তাই না হারায়--
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক-পানে॥

আমি তার মুখের কথা শুনব ব'লে গেলাম কোথা,
শোনা হল না, হল না--
আজ ফিরে এসে নিজের দেশে এই-যে শুনি
শুনি তাহার বাণী আপন গানে॥

কে তোরা খুঁজিস তারে কাঙাল-বেশে দ্বারে দ্বারে,
দেখা মেলে না মেলে না,--
ও তোরা আয় রে ধেয়ে দেখ্‌ রে চেয়ে আমার বুকে --
ওরে দেখ্‌ রে আমার দুই নয়ানে॥

আমার মল্লিকাবনে

আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি
তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি॥

তখনো কুহেলীজালে,
সখা, তরুণী উষার ভালে
শিশিরে শিশিরে অরুণমালিকা উঠিতেছে ছলোছলি॥

এখনো বনের গান, বন্ধু হয় নি তো অবসান--
তবু এখনি যাবে কি চলি।
ও মোর করুণ বল্লিকা,
ও তোর শ্রান্ত মল্লিকা
ঝরো-ঝরো হল, এই বেলা তোর শেষ কথা দিস বলি॥

আমার হিয়ার মাঝে

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি ॥

আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি ॥

তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়--
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়।
গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দুঃখসুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গান তো গাই নি ॥

আমার বেলা যে যায়

আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে ॥

একতারাটির একটি তারে গানের বেদন বইতে নারে,
তোমার সাথে বারে বারে হার মেনেছি এই খেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে ॥

আমার এ তার বাঁধা কাছের সুরে,
ওই বাঁশি যে বাজে দূরে।
গানের লীলার সেই কিনারে যোগ দিতে কি সবাই পারে
বিশ্বহৃদয়পারাবারে রাগরাগিণীর জাল ফেলাতে--
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে?।

আজি বিজন ঘরে


আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে--
আমি তাইতে কি ভয় মানি!
জানি জানি, বন্ধু, জানি--
তোমার আছে তো হাতখানি ॥

চাওয়া-পাওয়ার পথে পথে দিন কেটেছে কোনোমতে,
এখন সময় হল তোমার কাছে আপনাকে দিই আনি ॥

আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ-অন্ধ-করা,
তোমার পরশ থাকুক আমার-হৃদয়-ভরা।
জীবনদোলায় দুলে দুলে আপনারে ছিলেম ভুলে,
এখন জীবন মরণ দু দিক দিয়ে নেবে আমায় টানি ॥